আল কুরআনে নারী: মর্যাদা, অধিকার ও ইসলামের মৌলিক অবস্থান (প্রথম খন্ডের আলোকে)

​আল কুরআন—আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের একমাত্র নির্ভুল বাণী-সম্ভার এবং কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির জন্য পথনির্দেশিকা। এই মহাগ্রন্থে মানুষের জীবনের প্রতিটি দিক সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত অধ্যাপক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন-এর ‘আল কুরআনে নারী – প্রথম খন্ড’ গ্রন্থে সেই কুরআনের আলোকেই নারীর সঠিক মর্যাদা, অধিকার ও দায়িত্ব নিয়ে গভীর আলোচনা করা হয়েছে।

​পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজে নারীকে যে নিম্নমানের চোখে দেখা হতো বা হয়, ইসলাম সেখানে নারীকে সর্বোচ্চ সম্মান ও অধিকার দিয়ে সমাজের মূল কেন্দ্রে স্থাপন করেছে।

মানবের সৃষ্টিতে নারী-পুরুষের সমতা।


​ইসলাম নারীকে পুরুষের প্রতিপক্ষ হিসেবে নয়, বরং মানব সমাজের পূর্ণাঙ্গ অংশ হিসেবে দেখে। কুরআন ঘোষণা করে যে, মানব সৃষ্টির মৌলিক কাঠামোতে নারী ও পুরুষ উভয়ের অবস্থান সমান।

​একই সত্তা থেকে সৃষ্টি: আল্লাহ তাআলা নারী ও পুরুষ উভয়কে ‘নফসে ওয়াহেদা’ বা ‘একক সত্তা’ (আদি মানব আদম আ.) থেকে সৃষ্টি করেছেন।
​কুরআনের ঘোষণা: “হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের সেই রবকে ভয় করো, যিনি তোমাদের একটি মাত্র আত্মা (নফসে ওয়াহেদা) হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের দু’জন হতে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু নর-নারী।” (সূরা নিসা, ৪:১)

​কুরআনের ঘোষণা: “হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের সেই রবকে ভয় করো, যিনি তোমাদের একটি মাত্র আত্মা (নফসে ওয়াহেদা) হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের দু’জন হতে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু নর-নারী।” (সূরা নিসা, ৪:১)

​মর্যাদার ভিত্তি তাকওয়া: ইসলামে শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র মাপকাঠি হলো তাকওয়া (আল্লাহভীতি)। এটি নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। বংশ, জাতি, লিঙ্গ বা সম্পদের ভিত্তিতে নয়, বরং আল্লাহভীতিতে যে যত অগ্রগামী, সে আল্লাহর কাছে তত সম্মানিত।

​২. নারীর অর্থনৈতিক ও সম্পত্তিগত অধিকার
​ইসলাম নারীকে এমন কিছু অধিকার প্রদান করেছে যা ঐশ্বরিক আইনের ইতিহাসে বিরল। এর মধ্যে অন্যতম হলো নারীর সম্পত্তি ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা।

​স্বাধীন মালিকানা: নারী স্বাধীনভাবে তার অর্জিত সম্পদের মালিক হতে পারে। পৈতৃক সম্পত্তি, স্বামীর সম্পত্তি (দেনমোহর), বা নিজের উপার্জিত সম্পদ—সবকিছুতেই নারীর পূর্ণ মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।

​উত্তরাধিকারের অধিকার: ইসলাম নারীকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার অধিকার দিয়েছে, যা বহু সমাজে অনুপস্থিত ছিল। যদিও ক্ষেত্রবিশেষে পরিমাণের তারতম্য রয়েছে, তবুও এই অধিকার নারীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করেছে।

​দেনমোহর (Mahr): বিবাহের সময় দেনমোহর নারীর একচ্ছত্র অধিকার। এটি একটি উপহার নয়, বরং স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর প্রাপ্য বাধ্যতামূলক অধিকার।

​৩. শিক্ষায় নারীর অধিকার ও গুরুত্ব
​জ্ঞানার্জন করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরজ। এই ফরজ নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।

​জ্ঞানের সন্ধানে উৎসাহ: ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায়, নারীরা জ্ঞানার্জন ও চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। হযরত আয়িশা (রা.) ছিলেন ইসলামের অন্যতম বড় জ্ঞানী, যিনি বহু সাহাবাকে ধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছেন।

​জাতি গঠনে ভূমিকা: ইসলাম বিশ্বাস করে, একটি শিক্ষিত মা-ই পারে একটি শিক্ষিত ও শক্তিশালী জাতি গঠন করতে।

​৪. পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা
​ইসলাম নারীকে পরিবারে ‘রাঈয়্যাহ’ বা তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে।
​মাতৃত্বের সর্বোচ্চ সম্মান: ইসলামে মাতৃত্বকে যে সম্মান দেওয়া হয়েছে, অন্য কোনো ধর্মে বা মতবাদে তা বিরল। রাসূল (সা.)-এর সেই বিখ্যাত উক্তি—”মায়ের পদতলে সন্তানের জান্নাত”—মাতৃজাতির প্রতি ইসলামের সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শনের প্রতীক।

​স্বামীর প্রতি দায়িত্ব: স্বামী ও স্ত্রী উভয়েরই উভয়ের প্রতি কর্তব্য রয়েছে। পরিবারে স্ত্রী হলেন স্বামীর সহযোগী ও অংশীদার। কুরআন এটিকে ‘পরস্পরের পোশাক’ (লিবা-সুন) হিসেবে আখ্যায়িত করেছে, যা পারস্পরিক নির্ভরতা ও সুরক্ষার প্রতীক।

​৫. সমাজের প্রতি নারীর দায়িত্ব
​ইসলাম শুধু নারীর ব্যক্তিগত জীবনের অধিকার নিয়েই কথা বলেনি, বরং সামাজিক জীবনেও তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য উৎসাহিত করেছে।

​দাওয়াতে অংশগ্রহণ: ভালো কাজের আদেশ দেওয়া এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করার (আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার) দায়িত্ব নারী-পুরুষ উভয়ের। এই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে নারী সমাজ সংস্কারের কাজে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারে।

​ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: সমাজে ন্যায়বিচার ও সত্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নারীর কণ্ঠস্বর সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

নারীর প্রতি কুরআনের বার্তা
​অধ্যাপক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইনের এই গ্রন্থটি প্রমাণ করে যে, কুরআন নারীকে কোনোভাবেই পুরুষ থেকে নিম্নমানের বা পুরুষের অধীনস্থ হিসেবে দেখেনি। বরং, নারীকে তার অধিকার, মর্যাদা ও দায়িত্বের মাধ্যমে একটি সুষম ও কল্যাণকর সমাজ গঠনের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেছে।

​কুরআন অনুযায়ী, নারী হলো:
১/ ​মানব সমাজের অপরিহার্য অংশ।
২/ ​অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন।
৩/ ​জ্ঞানার্জন ও চর্চার অধিকারী।
৪/ ​পারিবারিক স্থিতিশীলতার মূল ভিত্তি।

​এই বইটি আধুনিক সমাজে ইসলাম ও নারীর ভূমিকা সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ধারণা দূর করতে সহায়ক হবে।

Download Now

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *